রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৩ পূর্বাহ্ন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেন বারবার তাণ্ডব

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেন বারবার তাণ্ডব

স্বদেশ ডেস্ক:

সুরসম্রাট আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের সরোদ মঞ্চের পেছনের দিকে খোলা জায়গাজুড়েই গাছপালা। সবুজ পাতার ফাঁকে ফুটে থাকা টকটকে লাল জবা দেখে মনে হবে, যেন চৈত্রের বাতাসে দুলছে বাংলাদেশের পতাকা। প্রকৃতির এমন দৃশ্যপট পাল্টে যাবে একটু পেছনে ঘুরলেই। স্থানে স্থানে তা-বের ক্ষত আর ধ্বংসস্তূপ। আগুনে পোড়া সবুজ গাছপালা এখন বিবর্ণ। সংগীতাঙ্গনে থাকা বিরল সংগ্রহ, মঞ্চ থেকে প্রকৃতি- কিছুই বাদ যায়নি হামলাকারীদের হাত থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, থানা, মন্দির, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও মুক্তিযুদ্ধের স্বাক্ষর বহনকারী স্থাপনাগুলোও ছিল তাদের প্রধান টার্গেট।

গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা। শহরজুড়েই নেমে আসে বিভীষিকা। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, স্কয়ারসংলগ্ন আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুক্তমঞ্চ, মঞ্চের পাশের বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা, পৌর মার্কেট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, প্রেসক্লাব, ডাকবাংলো, থানা, ফাঁড়ি, রেলস্টেশন, ভূমি অফিসসহ ৪০টির বেশি সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়।

এর আগে ২০১৬ সালে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো শহরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। তখনো শহরের অন্যানা স্থাপনার সঙ্গে সুরসম্রাট আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন আক্রান্ত হয়। বরাবরই হামলাকারীদের টার্গেট থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক চর্চার অন্যতম পীঠস্থান এই কেন্দ্র। এ ছাড়া ২০০০ সালে প্রশিকার মেলার বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে তা-বে প্রাণ হারান ছয়জন। এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিককর্মী, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন- একই ধরনের অপরাধ বারবার করে একটি নির্দিষ্ট মৌলবাদী গোষ্ঠী পার পেয়ে গেলে ভিন্ন বার্তা যায়। এবারের ঘটনার পরও সে ধরনের নমনীয় (মামলায় সুনির্দিষ্ট নাম না থাকা) অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।

সুরসম্রাট আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে হামলার প্রত্যক্ষদর্শী এক তরুণ আমাদের সময়কে বলেন, ‘তাদের দেখে মনে হচ্ছিল আক্রোশটা ছিল গানের ওপর। সেটা সংগীতাঙ্গনের স্থাপনার ওপর ঢেলে দেয় তারা। সবকিছু পুড়িয়ে ফেলে।’ শহরের যেসব স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল রয়েছে, সেসব স্থানেও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। সরেজিমন গিয়ে দেখা যায়, আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুক্তমঞ্চের পাশের বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও ব্যাংক এশিয়ার শাখার পাশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অনেক অংশই ধ্বংস করা হয়েছে। বিকৃত করা হয়েছে ম্যুরাল। হামলার ধরন বলছে, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের প্রতিও হামলাকারীদের তীব্র ক্ষোভ।

স্থানীয় সাংস্কৃতিককর্মী মনির হোসেন বলেন, ‘এর আগে ১ ডিসেম্বরেও বঙ্গবন্ধুর সব প্রতিকৃতি বিনষ্ট করে দিয়েছিল দুষ্কৃতকারীরা। এবারও তা-বের সময় হামলাকারীদের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি। শহরের যেখানেই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ছিল, তারা সেখানেই হামলা চালিয়েছে। ব্যানার-ফেস্টুনে আগুন দিয়েছে। রেলস্টেশনে বঙ্গবন্ধুর ছবির একটা প্রদর্শনী চলছিল, সেটিও তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।’

জাতীয় প্রেসক্লাব, সার্কিট হাউসসহ বিভিন্ন স্থাপনায় গিয়ে দেখা যায়, এখনো রয়েছে গেছে ধ্বংসচিহ্ন। এদিক-সেদিক পড়ে আছে ভাঙা কাচের টুকরো। ডাকবাংলোসহ বিভিন্ন স্থাপনায় পোড়ার দগদগে ক্ষত। বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের দুজন বৃদ্ধার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা জানান, এবারের তা-বের কিছু কিছু নমুনা দেখে একাত্তরের নিষ্ঠুর হামলার কথা মনে পড়ে যায়। দু-একটি হামলার সঙ্গে সে সময়ের কিছু হামলার মিলও খুঁজে পান তারা।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার আহ্বায়ক আব্দুন নূর আমাদের সময়কে বলেন, ‘মানুষ সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন হলে তাদের ধর্মব্যবসা ব্যাহত হতে পারে। তাই এর আগেও সাংস্কৃতিককেন্দ্রগুলোর ওপর আঘাত এসেছে। বর্তমান এবং অতীতের শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তারা এই জায়গায় চলে গেছে। আইজিপির বক্তব্যের মধ্যেও সরকারের আপসকামী মনোভাবের প্রতিফলন বোঝা যায়। সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি আছে বলে আমরা মনে করি।’

২০ মামলা গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক সহিংস তা-ব চলে। হেফাজতে ইসলামির কর্মসূচি চলাকালীন এই সহিংস কর্মকা- চলে। তবে এখন এসব ঘটনার দায় নিতে চাইছে না কোনো পক্ষই। এমনকি পুলিশ বাদী হয়ে এ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দায়ের করা ২০টি মামলায় হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আসামি করা হয়নি। বরং তৃতীয় পক্ষ জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে প্রশাসনই।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ২৬ মার্চ হেফাজতের নেতাকর্মীরাই মাঠে ছিলেন। তার পরের দ্ইু দিন হেফাজতের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়ে। হেফাজতকে রসদ জোগাতে অর্থায়ন করে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও- এমন তথ্যও উঠে এসেছে ইতোমধ্যে।

বারবার তা-বের পর মামলা হলেও তার সুরাহা কেন হয় না- এমন প্রশ্নের জবাবে গত বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কিট হাউসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘আপনারা নির্ভয়ে মামলা করেন। তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

শহরজুড়ে নিরাপত্তাবলয় সহিংসতার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরজুড়ে বাড়ানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে শহরজুড়ে। সন্ধ্যার পর যৌথ বাহিনীর টহল চোখে পড়ে শহরের বিভিন্ন সড়কে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সহিংসতায় মানুষের মনে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার হয়েছে। মানুষকে সাহস দিতে এই আয়োজন।

খুলে নেওয়া হয়েছে সিসি ক্যামেরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকা বেশিরভাগ সিসি ক্যামেরা খুলে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। সহিংস কর্মকা- ধারণ হয়ে থাকলে পরে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রশিক্ষিত কর্মীরা এমন কর্মকা- করেছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সিসি ক্যামেরা খুলে নিয়ে যাওয়ার কারণে মামলার তদন্তে প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, প্রথম দিনের তাণ্ডব এর পরও পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল না জেলা শহরে। এমনকি হরতালের দিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত শহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকেও দেখা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় লোকজন বলছেন, সহিংসতার বিষয়ে আগাম কোনো গোয়েন্দা তথ্যও সংগ্রহ করতে পারেনি জেলা পুলিশ।

জানতে চাইলে হেফাজতের জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা সাজেদুর রহমান বলেন, আমরাও এই তা-বের নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময়কার অনেক ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। সেসব দেখে দোষীদের শনাক্ত করার দাবি আমরাও জানিয়েছি।

উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের প্রতিবাদে গত শুক্রবার (২৬ মার্চ) রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদে বিক্ষোভ ঘিরে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনার জেরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওইদিন বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওইদিন চট্টগ্রামে ৪ জন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজনের মৃত্যু হয় গুলিতে। এর পর সহিংসতা বাড়তে থাকে। তিন দিনের তা-বে বাহ্মণবাড়িয়ায় এ পর্যন্ত মোট প্রাণ গেছে ১২ জনের।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877